রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬

হাতকড়া হাতে হাসপাতালে অসাড় দ্বিজেন টুডু, ছররা গুলিতে বিদ্ধ চোখ



সাঁওতাল পল্লী থেকে কোনওদিন বের হতে হয়নি যে দ্বিজেন টুডুকে চিকিৎসার স্বার্থে তাকে ঢাকায় আসতে হয়েছে। কোমরে দড়ি, হাতে হাতকড়া। সারা শরীরে অর্ধশত ছররা বুলেট। চোখেও গুলি। একচোখ বন্ধ, রক্তে ভেজা চারদিন পরও। আরেক চোখে গুলি না লাগলেও বাম চোখের রক্ত গড়িয়ে সে রক্ত শুকিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনজন পুলিশ তাকে দিনরাত পাশের বেডে বসে পাহারা দিচ্ছে। কাতর দ্বিজেন একা উঠে দাঁড়াতে না পারলেও পাহারা আর হাতকড়া দিব্যি রয়েছে সঙ্গে।

গত ৬ নভেম্বর রবিবার গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকল এলাকার মাদারপুর ও জয়পুরে সাঁওতালদের পল্লীতে এ হামলার ঘটনায় পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি মুখেও ঢুকে গেলে প্রথমে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সেটি বের করা হয়। কিন্তু চোখের বুলেট বের করা যায়নি বলে আসামী দ্বিজেনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন তিনি।
কেবল দ্বিজেন নয়, ঘর হারানো এই আহতরাই উল্টো আসামি হয়েছেন মামলায়। গাইবান্ধায় পুলিশের গুলি ও সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত সাঁওতালদের কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গ্রেফতার দেখানো হয়েছে তাদের।

মারাত্মক আহত অবস্থায় প্রায় অসাড় দ্বিজেন টুডুকে গত ৮তারিখ গাইবান্ধা পুলিশ লাইনের রিজার্ভ পুলিশের হেফাজতে ঢাকায় পাঠানোর পর বর্তমানে চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন তিনি। পাশে থেকে সেবা করে চলেছেন তার ছোট বোন। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ওষুধের যাবতীয় কাজ পুলিশের সহায়তায় করা হলেও বেশিরভাগ খরচ নিজেদেরই করতে হচ্ছে। সহায় সম্বলহীন দ্বিজেন টুডুর পরিবার জানে না এ খরচ তারা কোথা থেকে জোগাবেন।

কী হয়েছিল জানতে চাইলে দ্বিজেন টুডুর বোন বলেন, ৬ নভেম্বর রবিবার পুলিশের সহায়তায় সন্ত্রাসীরা বাবা-দাদার ভিটে থেকে তাদের জোর করে উচ্ছেদ করেছে। তাদের বেদম মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। মালামাল লুট করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ভাই বা আমার কোনও বাড়িঘর নাই। উল্টা ওকে হাসপাতালে আনার পর জানতে পারি আসামি নাকি উল্টো এরাই।
পুলিশের যে তিনজনকে এদের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এরা এত টাকা কোথায় পাবে। আজ ৫ হাজার টাকার পরীক্ষা করানো হয়েছে। চলার সামর্থ্য নাই। উঠে দাঁড়াতে পারে না। আমরাই ধরাধরি করে সব জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। ওদের পরিচিত একজন আজ এসে কিছু টাকা দিয়ে গেছে। হাতকড়া পরানো কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হেফাজতে এতদূর নিয়ে এসেছি। হাতকড়া খোলার নিয়ম নাই। যদিও খুলে দিলেও সে পালানো সামর্থ রাখে না। কিন্তু আমার উপায় নেই।

আহত দ্বিজেন টুডুর দুই সন্তান। ছোট সন্তানদের বাড়িতে রেখে স্ত্রী আসতে পারেননি। বোন একটু পরপর দ্বিজেনের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছিয়ে দিচ্ছেন পাতলা কাপড় দিয়ে, কিন্তু তার নিজের চোখের পানি মোছানোর কেউ নেই। আঁচল দিয়ে নিজ চোখে পানি মুছতে মুছতে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিলো। আমাদের পেটে খাবার নাই। শহরে শীত নাই, কিন্তু ওখানে এই হিমে আমাদের বুদ্ধরা, ছোটরা কীভাবে আছে কেউ দেখার নাই।

কথার এক পর্যায়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলেন, ভাইকে মেডিক্যাল থেকে যে ভাত দিয়েছে সেইটা ভাগ করে খাই আমি, তাওতো খাই। ওরাতো তাও খেতে পায় না দিদি।
ব্যথা কোথায় প্রশ্ন করলে ইশারায় দ্বিজেন কপালে হাত দিয়ে দেখান। চোখের ঠিক পরে সেখানেও তিনটি বুলেট। পুলিশের সদস্য বলেন, মাথাতেও অনেকগুলো আছে। এরপরও দ্বিজেন আবারও মাথা না দেখিয়ে আবারও কপালেই দেখান। বেশি ব্যাথা কপালে জানতে চাইলে তিনি মুখে কিছু বলেন না। আধা বন্ধ ডান চোখ দিয়ে আবারও পানি গড়িয়ে পড়ে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন