আজকাল খবরের কাগজ খুলতেই চোখে পরে সেই নির্মম দৃশ্য গুলো। প্রায় প্রতিদিনই শোনা যায় ইভটিজিং,ধর্ষণ,কুপিয়ে যখম,গলাকেটে হত্যা এবং নানা ধরনের নির্যাতনের কথা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা নারীরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের নিরাপত্তা।
প্রায়ই মনে প্রশ্ন জাগে, এই একবিংশ শতাব্দীতেও কেন নারীর জন্য একটা নিরাপদ রাষ্ট্র পেলাম না? সেই পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের ছবিগুলোতে যখন দেখি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি রাজনৈতিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক আন্দোলনে নারীরা রাজপথে, তখন আমার গর্ব হয়। অথচ আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রেনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বত্রই আজ আমরা নিপীড়নের শিকার। রেহাই নেই ফেসবুক বা অনলাইনেও।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে, গত বছর সারা দেশে উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৩৬২ জন নারী ও শিশু। এরই মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিকার না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২২ জন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০৯ জন নারী রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বখাটেদের উৎপাতের শিকার হয়েছে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫১২টি।
পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আমরা কতটা সংকটের মুখে পরে আছি। আপনারা যদি বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে গিয়ে বাংলাদেশের নানা ধরনের অপরাধের তথ্য যিনি দেখবেন তিনি চমকে উঠবেন। চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণসহ যেকোনো অপরাধের চেয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেশি ঘটে এ দেশে। গত এক যুগে হিসাব করলে দেখা যায় সেই সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এ পরিসংখ্যান দেখে প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশের পুরুষরা কি আদৌ সভ্য? আদৌ কি তারা পুরুষ?
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এমন দিন খুব কমই গেছে যেদিন দেশের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে নারী নিপীড়নের খবর আসেনি, একটার পর একটা হত্যাকান্ড। কখন মাদারীপুরের নিতু, কখনো অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসা, কখন তনু, কখনো সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা আছেই এই দেশের খবরে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান মনে করেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এরা একটু ভয় পাবে। এ জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর পাশাপাশি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।
এর পর পরই শোনা যায় বদরুল আলমের চাপাতির কোপে খাদিজার ক্ষত না শুকাতেই আবারও মুন্সিগঞ্জের চরমোদন গ্রামে দশম শ্রেণির ছাত্রী তাহমিনা জাহানকে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। তাহমিনা ছাড়াও আফছানা, দিনাজপুরের ৫ বছরের শিশু পূজা সহ আরও অনেক কেই এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
আর এই প্রতিটি ঘটনাই ঘটিয়েছে পুরুষ নামের কতগুলো ‘মানুষ’। সত্যিই কি তারা মানুষ? নাকি অন্নকিছু? মানুষ কি কখনো মানুষকে কোপাতে পারে? মানুষ হলে নিশ্চয়ই তারা নারীর চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করত না। যে বখাটেরা এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা কি একবারও ভাবে না, যে এই দেশেই তো তাদেরও মা, বোন কিংবা অন্য কোনো স্বজনকে চলাফেরা করতে হয়। পুরুষ হয়ে তারা যদি আরেকটি মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে তাদের মা-বোনকে নিরাপত্তা দেবে কে?
হাইকোর্ট বিভাগ যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালের ১৪ মে একটি নির্দেশনামূলক রায় দেন। তাতে উল্লেখ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ সর্বস্তরে নারীর ওপর যৌন হয়রানিমূলক আচরণ প্রতিরোধে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কেউ যদি অশোভন আচরণের শিকার হয় তাহলে নিকটস্থ থানায় বা দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে জানাতে পারেন। অনলাইনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করবেন। আবার দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, কোনো নারীকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়, তাহলে এক বছর কারাদণ্ড হতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশের ৭৬ ধারা অনুযায়ী, নারীদের উত্ত্যক্ত করার ফলে শাস্তি কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ড। আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও ১০ বছর সাজার বিধান রয়েছে। কিন্তু শুধু আইন দিয়ে কি সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে? নাকি এর জন্য মানসিকতা বদলানো জরুরি।
বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তেই নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটুক না কেন, একজন পুরুষের পক্ষ সেটি শোনা লজ্জা জনক। সবাই দাড়িয়ে থেকে ভিডিও না করে, সবাই মিলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে কলঙ্কজনক এসব ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব। সত্যিকারের মানুষ কখনো নারী নিপীড়ন করতে পারে না। যারা এসব ঘটাচ্ছে তারা ‘পুরুষ’নামের হিংস্র পশু। পশু হয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে তারা। আর যেন কোন পুরুষকে লজ্জিত হতে না হয়। কাজেই পুরুষ জাতির কাছে আমার অনুরোধ, তোমরা সত্যিকারের মানুষ হও।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন